চাকরিতে প্রবেশসীমা ও অবসরসীমা বৃদ্ধিঃ কেন নয়?
বেসরকারি চাকরিবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে চাকরি নিশ্চয়তা ও ক্ষতিপূরণের পথ রেখে তরুনদেরকে বেসরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকতে সুযোগ করে দিতে হবে। শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে সরকারি চাকরির বয়সসীমা তুলে দিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে একজন শিশু ন্যূনতম ০৪ বছর বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে আরো বেশিও হতে পারে। যদি ধরে নেওয়া হয় নিধি নামক শিশুটি কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়াই এসএসসি পাশ করল। তখন তার বয়স ১৪ বছরের কিছু বেশি। কোন ঝামেলা ছাড়া এইচএসসি পাশ করলে তখন নিধির বয়স দাঁড়ায় কমপক্ষে ১৬ বছর ৬ মাস। এইচএসসি শেষ করে যখন নিধি সেশনজট ছাড়া স্নাতক শেষ করে তখন তার বয়স দাঁড়ায় ২১ বছর ৬ মাসে। এখন সে চাকরি প্রত্যাশী।
আর যদি ধরে নেই এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতকে ২ বছরের সেশনজটসহ নিধির বান্ধবী ফারিয়া স্নাতক সম্পন্ন করে তবে ফারিয়ার বয়স হবে ২৫ বছর ৬ মাস। এখন ফাড়িয়া চাকরি খুঁজছে। ফারিয়া যদি প্রাথমিকে ৫ বছর বয়সে ভর্তি হয় তবে স্নাতক শেষে তার বয়স দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ২৭ বছর।
বর্তমানে বিদ্যমান সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর। তাহলে ফাড়িয়া চাকরির প্রস্তুতি নিতে ৩ বছরের বেশি সময় পাবে। কারন ৩০ বছর বয়সে সে আবেদন করবে আর পরীক্ষা দিতে থাকবে আরো প্রায় ১ বছর। ঐদিকে নিধি প্রায় ৮ বছর চাকরির প্রস্তুতির সময় পাবে। ৩ - ৮ বছর সময়টা কিন্তু নেহায়েত কম নয়। একজন মানুষের গড় আয়ুর প্রায় ১৫/২০ ভাগের এক ভাগ। একজন পরিশ্রমী, উদ্দোমী, অধ্যবসায়ী ছাত্রের পক্ষে এই সময়ে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ১ম স্থানে থাকা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, এই সময়ে একজন উদ্যোক্তা সফল হতে পারে।
যদি কোন ছাত্র পরিশ্রমী না হয়, অধ্যবসায়ী না হয় তবে সে ৩-৮ বছর কেন, ১০ বছরেও কোন ফল দিতে পারবে না। এটা স্বাভাবিক এবং সত্য। এর উদাহরণ আমাদের চারপাশে অহরহ বিদ্যমান। ব্যতিক্রমী কিছু সফলতার কথা হয়ত অনেকেই শুনাবে। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু সফলতার গল্প উদাহরণ হতে পারে না। আপনি চারপাশে তাকান, দেখবেন যাদের চাকরি হয়েছে বা যারা সফল তারা ক্যারিয়ারে খুব অল্প সময়েই সফল হয়েছে।
আবার প্রশ্ন উঠতে পারে উপরিউক্ত হিসাবে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার বয়স হিসাব করা হয় নি। একজন সরকারি চাকরিপ্রার্থী নিজের টাকা-সময় নষ্ট করে কেন স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করবেন? তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করবেন সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে। আর যদি কেউ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেনই, তবে তিনি চাকরিপ্রার্থী হবেন কেন? তিনি হবেন দেশ বরেন্য গবেষক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর নমুনা জরিপ ২০২৩ এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর। বিদ্যমান নীতি অনুযায়ী একজন সরকারি চাকরিজীবী ৬০ বছর বয়সে অবসরে যান। ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন ভোগ করেন। সুতরাং তার জীবদ্দশায় অর্থ সংকট নেই, সামাজিক মুল্যবোধের সংকট নেই, অবসর যাপনের সমস্যা নেই। তবে কেন ৬০ বছরের বেশি সময়ে অবসরে যেতে হবে!
ধরে নিচ্ছি চাকরির বয়স সীমা বাড়িয়ে ৩২ করা হল। এতে কি হবে? ২ বছরে নতুন করে বেকার লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। যারা পরিশ্রমী তারা একটার পর একটা চাকরি পরিবর্তন করতে থাকল। যারা পরীশ্রমী নয় তারা ২ বছর বেশি সময় সোনার হরিণের পেছন পেছন দৌড়াতে থাকল। খুব কম সংখ্যক লোক সোনার হরিণের দেখা পেল, বাকিরা হতাশায় নিমজ্জ্বিত হল। কিন্তু যদি চাকরির বয়স সীমা ৩০ ই থাকে তবে ৩০ বছর পার হওয়ার পর সবাই নিজ নিজ নতুন রাস্তা খুঁজতে শুরু করত। বয়সসীমা বৃদ্ধি করার কারনে যুবসমাজের মাঝে এক ধরণের অলসতা আসবেই আসবে। এতে দেশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছেলে-মেয়েদের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলে তথাকথিত সেটেল হতে হয়। মানে, তাদের চাকরি কিংবা অন্য পন্থায় আয়-রোজগারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয় সে তার সংসারের হাল ভালোভাবেই ধরতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাকরিতে প্রবেশসীমা ৩০ বছর থাকতেই একজন সেটেল হতে পারছেনা, ৩৫ করা হলে সে সেটেল হবে কবে? বিয়ে-সংসার করবে কবে? আমরা জীবনে সফলতার পাশাপাশি সুখ-শান্তি খুঁজে থাকি।
আপনি জীবনে যত তাড়াতাড়ি সমস্যার সম্মুখীন হবেন কিংবা দায়িত্ব কাঁধে নিবেন, তত তাড়াতাড়ি আপনি দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যময় জীবন গঠনের পাশাপাশি সফলতার দিকে হাঁটবেন এবং জীবনের শেষের দিকে আপনি তত রিলাক্স হবেন। আর জীবনের সবচেয়ে দায়িত্ব-কর্তব্যময় অংশ হলো সংসার জীবন। এই সংসার জীবনে পা বাড়ানোর জন্য যদি আপনার চাকরি খুঁজতেই ৩৫ চলে যায়, স্যাটেল হতে চলে যায় আরো ০২ বছর; তবে ৩৭ বছরে সংসার জীবনে ঢুকে কতটুকু রিলাক্স পাবেন? আপনার সন্তানদের জন্য কটটুকু নিরাপদ আশ্রয় তৈরী করতে পারবেন কিংবা লেখাপড়া বা বিয়েশাদি দিয়ে আপনি রিলাক্স হবেন কখন? মৃত্যু অবধি আপনি গাধার মত খেটেই যাবেন?
সমাধানের পথ কী হতে পারে? অবসরসীমা ৬০ বছর ও প্রবেশসীমা ৩০ বছরই থাকবে। সরকার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য এমন এক কারিকুলাম বাস্তবায়ন করবে যা পড়ে তারা চাকরিপ্রার্থী হওয়ার আগ্রহ কমিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সংস্থা গঠন করে বেসরকারি চাকরিবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে চাকরি নিশ্চয়তা ও ক্ষতিপূরণের পথ রেখে তরুনদেরকে বেসরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকতে সুযোগ করে দিতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সংস্থা বেসরকারি প্রতিষ্ঠাগুলো তদারকির দায়িত্বে থাকবে। শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে সরকারি চাকরির বয়সসীমা তুলে দিতে হবে। চাকরির সময়সীমার উপর ভিত্তি করে আনুপাতিক হারে সুবিধাদি দেওয়ার মাধ্যমে আর্থিক সুবিধার দিক বিবেচনা করা যেতে পারে। সর্বোপরি আমাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন না করলে কোন কিছুই কোন কাজে আসবে না।
মোঃ নাজমুল ইসলাম, প্রভাষক (পরিসংখ্যান), আলীমউদ্দিন জোবেদা কলেজ।