আলোচনায় “সেভেন সিস্টার্স”: বাংলাদেশের ভূমিকা
বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহনের পরপরই আলোচনায় আসে “সেভেন সিস্টার্স”। শুধু যে একারনেই আলোচিত হয় বিষয়টি এমনও নয়। আলোচনায় আসার আরেকটি কারন হচ্ছে, তাদের জাতীয়তাবাদের সশস্ত্র আন্দোলন, সীমানা বিরোধ ও নানা প্রশ্নে বিরোধ। এছাড়াও শিলিগুড়ি করিডোর বা কথিত ‘চিকেনস নেক’ নিয়েও আলোচনায় ‘সেভেন সিস্টার্স’।
বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহনের পরপরই আলোচনায় আসে “সেভেন সিস্টার্স”। শুধু যে একারনেই আলোচিত হয় বিষয়টি এমনও নয়। আলোচনায় আসার আরেকটি কারন হচ্ছে, তাদের জাতীয়তাবাদের সশস্ত্র আন্দোলন, সীমানা বিরোধ ও নানা প্রশ্নে বিরোধ। এছাড়াও শিলিগুড়ি করিডোর বা কথিত ‘চিকেনস নেক’ নিয়েও আলোচনায় ‘সেভেন সিস্টার্স’।
১৯৭৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে আসামের মূখ্যমন্ত্রী শরৎচন্দ্র সিনহা প্রথম ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দটি ব্যবহার করলেও ২০২০ সালে দ্য সেন্টিনেল পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জে পি শইকিয়ারকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ কথাটির স্রষ্টা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও মেঘালয় সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর উন্নয়নের জন্য গড়ে তোলা উত্তর-পূর্ব পরিষদ (এনইসি)-এ ২০০২ সালে সিকমকে অন্তর্ভূক্ত করা হলে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে “সাত বোন এক ভাই”ও পরিচিতি পেয়েছিল।
সেভেন সিসস্টার্সের ভৌগোলিক অবস্থা, জনসংখ্যা, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় একই রকম মনে করা হলেও রাজ্যগুলোর ভাষা-সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থা ক্ষেত্র বিশেষে সম্পূর্ণ বা অনেকটা ভিন্ন। অসমীয়া, বাংলা, হিন্দি, মণিপুরী, খাসী, নেপালীসহ অন্তত ১৫ টি প্রধান ভাষা রয়েছে। সংস্কৃতিতে রয়েছে অনেক তফাত। এত তফাত থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মিল রয়েছে। তাদের মাঝে জাতিগত বিরোধ পূর্ব থেকেই বিদ্যমান যা আজও চলমান রয়েছে। ভারতের প্রধান অংশের সাথে সেভে সিস্টার্সকে যুক্ত করেছে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেনস নেক।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু ও মুসলিম পরস্পর দ্বন্দ্ব-বিদ্রোহের ইতিহাস অনেক পুরাতন। তাছাড়াও হিন্দু, খ্রিস্টান, কুকি, বাঙালি-অবাঙালি ও উপজাতীয়দের বিরোধের জের আজও রয়ে গেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন ‘আফম্পা’ দীর্ঘদিন বলবৎ হয়েছে এর কারনেই।
কথিত সেভেন সিস্টার্সে বিদ্রোহ বলতে বিভিন্ন রাজ্যের একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা সংঘটিত বিদ্রোহকেই বোঝায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যের বিদ্রোহী সংগঠন ও কেন্দ্রিয় সরকার, আদীবাসী জণগণ, অভীবাসীদের মধ্যে সংঘাত বিদ্যমান। বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ বিদ্রোহ অনেকটাই কমে এসেছিল। আবার বিগত বিএনপি সরকারের সময় এ বিদ্রোহ বেড়ে গিয়েছিল। এ কারনেই ভারত আওয়ামী সরকারকে সেফ মনে করে এবং অন্য সরকারকে রিস্কি মনে করে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বক্তব্য খেয়াল করলে বুঝা যায়, সেভেন সিস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর প্রধান বা নেতাগণ বাংলাদেশে লুকিয়ে থেকে সংগঠনগুলো পরিচালনা করতেন। সেগুলো বিএনপি সরকার দেখেও না দেখার ভান করে থাকতেন এবং দিল্লী থেকে এর ব্যাপারে কোন কথা বললে তা ভিন্নভাবে তাদের অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করে উড়িয়ে দিতেন। ধারণা করা হয়, একারনেই তখন সেভেন সিস্টার্সে তুলনামূলক বেশি অস্থীরতা বিরাজ করত। কিন্তু আওয়ামী সরকার প্রকাশ্যে আলফা নেতা অনুপ চেতিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয় এবং অপ্রকাশ্যেও বহু নেতাকে তুলে দেও্যার গুঞ্জন শোনা যায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন “ভারতকে যা দিয়েছি তা আজীবন মনে রাখবে”। এই কথাটি তিনি খোলাসা না করলেও পূর্ববাক্যের দিকে নজর দেওয়াই যায়। ভারতের বিভিন্ন কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যেও তা ফুটে উঠে।
মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা জোরামথাঙ্গা বলেছিলেন, বাংলাদেশের সাহায্য না পেলে মিজোরাম পৃথক রাজ্য হতো না। তার কারনঃ দীর্ঘ ২০ বছর এ দলটি বাংলাদেশের আশ্রয়ে দল পরিচালনা করেছিল। এমএনএফ এর প্রশিক্ষন শিবিরগুলো ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক ভ্যালি ও আশপাশের এলাকায়। আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্টী আলফার পরেশ বড়ুয়া, অনুপ চেতিয়া, অরবিন্দসহ অনেক নেতাই বাংলাদেশের ভূখন্ডে থেকেছেন দীর্ঘদিন। ত্রিপুরার এনএলএফটি বা টিএনভি এর অনেক সদস্য বাংলাদেশে থেকেছেন। এখান ত্থেকেই দল পরিচালনা করতেন। আওয়ামী সরকারের জিরো টলারেন্সের নামে এসব নেতা-কর্মীদের ধরে ভারতের কাছে হস্তান্তর করতে থাকলে ধীরে ধীরে সেভেন সিস্টার্স অনেকটাই শান্ত হতে থাকে।
সেভেন সিস্টার্সের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিলে সেটিও আওয়ামী সরকারকে ভারতের কাছে সমাদৃত করে। এটি যে শুধু সামুদ্রিক সুবিধা দিয়েছে তা নয়, যোগাযোগ ও ভৌগোলিক দুরুত্বও অনেক কমিয়ে দিয়েছে। মায়ানমারের সাথে যে ভারতের কলাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কাজ ছিল তার গুরুত্ব কমে যায় শুধুমাত্র উক্ত সুবিধার কারনে। সেভেন সিস্টার্সকে সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে যে বাংলার ভূমিকা অপরিহার্য্য তা অনস্বিকার্য।
চিকেনস নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট। এটি মাত্র ২১-২৩ কিমি সরু একটি স্থান যাকে ঘিরে রয়েছে নেপাল, চীন, ভূটান ও বাংলাদেশের সীমান্ত। এটি খুবই ক্রিটিকেল পয়েন্ট। এটি প্রকাশ্যে উচ্চারিত করায় মুম্বাই আইআইটি ও দিল্লির জেওএনইউ এর প্রাক্তন ছাত্র শার্জিল ইমামের কারাবাস শুরু যা আজও শেষ হয়নি। বুঝতেই পারছেন চিকেনস নেক ভারতের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই চিকেনস নেকই একমাত্র ভারতীয় ভূখন্ড যেটি সেভেন সিস্টার্সকে ভারতের সাথে যুক্ত করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কৌশুলী চাওয়ায় রয়েছে এই চিকেনস নেক। তবে তাদের দাবী আদায়ে ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের নজর পাওয়া অত্যন্ত সহজ হবে।
শুধু যে বাংলাদেশ সেভেন সিস্টার্স বা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। সেভেন সিস্টার্সও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেভেন সিসস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তাদের রাজ্যগুলোকে অস্থিতিশীল করে গড়ে তুললে তার প্রভাব বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলেও পড়বে। এতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ, ভারতের আদীবাসী বা উপজাতিদের সাথে বাঙ্গালি আদীবাসি বা উপজাতিদের চাওয়া-পাওয়া সাদৃশ্যপূর্ণ। স্বভাবতই ভারতীয় উগ্ররা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলকে আশ্রয়স্থান হিসেবে বেছে নিবে এবং আমাদেরকেও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে।
মোঃ নাজমুল ইসলাম, প্রভাষক (পরিসংখ্যান), আলীমউদ্দিন জোবেদা কলেজ।